ঢাকা থেকে ৪০০ কিলোমিটারেরও বেশী দূরত্বে লালমনিরহাট জেলা সদর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে মোগলহাট ইউনিয়নের ধরলা নদীর তিনটি চর (চর ফলিমারি, নগদটারির চর ও ওসমান তাঁতীর চর) যার একপাশে কুড়িগ্রাম জেলা ও অন্যদিকে ভারতের সীমান্ত। যেখানে এখনও বিদ্যুত নেই, নেই কোন রাস্তা, চিকিৎসার কোন সুযোগ নেই, ছিল না প্রাথমিক শিক্ষা নেয়ার মত কোন ব্যাবস্থা। এই তিনটি চরে আমরা ২০১০ সাল থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জীবিকা ও পরিবেশ নিয়ে নিয়মিত কাজ করে হতদরীদ্র ২৩২ টি পরিবারের জীবন মান উন্নয়নে সচেষ্ট আছি। আমদের কাজের সফলতায় ২০১৮ সালে বিশ্ব স্কাউট সংস্থার এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের মধ্যে ডাইভার্সিটি ও ইনক্লশান অব স্কাউটিং প্রতিযােগিতায় আমাদের এই কাজ প্রথম স্থান অধিকার করে এবং গত ৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ তারিখে আন্তর্জাতিক ভলান্টিয়ার দিবস উপলক্ষ্যে জাতিসংঘ, একশন এইড, ভিএসও, যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশের সেরা দশটি প্রকল্পকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাদের কাজের সফলতায় স্থানীয় প্রশাসন ও এলাকাবাসী এই তিনটি চরকে “স্কাউটের চর” বলে। আমাদের উল্লেখযােগ্য কাজগুলাে হলাে:

১) একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে ৫ জন স্নাতক মানের শিক্ষককে দিয়ে ৬ টি ক্লাশে কম বেশি ১৩৫ জন ছাত্র ছাত্রীকে সকল শিক্ষা উপকরন, ইউনিফর্ম ও চিকিতসা সহ ফ্রি শিক্ষার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে আজ অবদি প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় পাশের হার ১০০%। এই স্কুলের প্রথম ব্যাচের দু’জন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পাশ করে আজ কলেজে পড়ছে । উচ্চতর ক্লাশে পড়া সকল শিক্ষার্থীদের শিক্ষা খরচও আমরা বহন করে থাকি ।

২) ২০১৫ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে এই তিন চরের ১১২ জন অবহেলিত হতদরীদ্র মহিলাকে দু’টি করে মাদি ছাগলের বাচ্চা দেয়া হয় । ছাগল বছরে দু’বার অন্তত দু’টি করে বাচ্চা দেয় । এতে করে এখন এই মহিলারা ১০-২০ টা ছাগলের মালিক । কেউ ছাগল বিক্রয় করে নতুন ঘর বানিয়েছেন, কেউ জমি বন্ধক নিয়েছেন, কেউ কলার বাগান করেছেন, কেউবা সোলার কিনেছেন । নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের এমন উদাহরন দেশে বিরল ।

৩) সারা বছর এই চরবাসী গোসত কিনে খেতে পারে না । তাই ২০১২ সাল থেকে ঐ চরে কোরবানি করে এর গোসত চরবাসীর মধ্যে বিতরণ করে আসছি। ৩) চরে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে আমরা মোট ১৫,০০০ বনজ ও ফলের গাছ লাগিয়েছি। মরুভূমিসম চর এখন সবুজ ।

৪) প্রতি বছর শীত নিবারণের জন্য শীত বস্ত্র দেয়ায় সকল পরিবারের কাছে এখন অন্তত ৭/৮ টি কম্বল, জ্যাকেট, সোয়েটার আছে।

৫) নিরাপদ খাবার পানির জন্য বন্যামুক্ত উচ্চতায় ২২টি টিউবওয়েল বসিয়ে ভিত্তি পাকা করে দিয়েছি।

৬) তিনটি রিং ও একটি স্ল্যাব সহ ৬২টি পরিবারে স্যানিটারি ল্যাট্রিন বসিয়েছি।

৭) মানুষের চিকিৎসায় ১৯ বার ফ্রি ঔষধসহ মেডিক্যাল ক্যাম্প ও গবাদি পশুর চিকিৎসায় ৮ বার ফ্রি ক্যাটল ক্যাম্প করেছি।

৮) ৩২টি বসবাসের ঝুপড়ি ঘরকে নতুন কাঠ, টিন ও আরসিসি পিলার দিয়ে ঘর বানিয়ে দিয়েছি।

৯) প্রতি বন্যায় এবং এখন লকডাউন-এ নিয়মিত খাদ্য ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছি।

১০) স্কুলে সকালে ধর্ম-শিক্ষকের তত্বাবধানে ধর্মীয় শিক্ষা দিচ্ছি।

১১) “জীবনের জন্য শিক্ষা” কার্যক্রমে রোভার স্কাউটরা জাতীয় সংগীত গাওয়া, জাতীয় পতাকা বানাতে পারা, থার্মোমিটার এ জ্বর মাপা, ফার্স্ট এইড, খাবার স্যালাইন তৈরী, দৈনন্দিন বিজ্ঞান ইত্যাদি শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে।

১২) জরাজীর্ণ মসজিদ ঘরটি সরিয়ে সেখানে একটি পাকা মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে।

১৩) প্রতি সপ্তাহে একদিন পর্যায়ক্রমে দুই দিন স্কুলে ডিমসহ খাবারের মাধ্যমে শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। ১৪) চরবাসীকে সাথে নিয়ে হাজার হাজার বালুর বস্তা নদীতে ফেলে ধরলার ভাংগন রোধে কাজ করে যাচ্ছি।

১৪) স্কুলের কিশোরীদের মাসের বিশেষ সময়ে স্বাস্থ্য সম্মতভাবে সুরক্ষার জন্য জ্ঞান ও প্যাড সরবরাহ করা হচ্ছে।

SDGsbyCrystal Scout
SDGsbyCrystal Scout
SDGsbyCrystal Scout

গত বছরের শুরুতে করােনা মহামারীর কারনে স্কাউটের চরের মানুষদের কাজ এবং আয়ের উৎস প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। অনিশ্চয়তার মধ্যে তাদের দিন কাটতে থাকে। আমরা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে আমাদের বন্ধু, অবিভাবিক, আত্মীয়, সহকর্মী ও সুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করি । প্রাথমিক ভাবে ৭০ টি পরিবারকে খাদ্যত্রান দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই । প্রতি পরিবারকে কিকি দ্রব্য কি পরিমানে দেয়া হবে তা চুড়ান্ত করি । বিতরন পদ্ধতি ঠিক করি । লালমনিরহাট জেলা রোভারের কাছে পরিকল্পনা ও টাকা পাঠাই । তারা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পরিকল্পনা অনুযায়ি দ্রব্য ক্রয়, প্যাকেট করা, পরিবহন ও ২৩ এপ্রিল ২০২০ তারিখে বিতরনের দায়িত্ব পালন করে । জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও জেলা স্কাউট নেতৃবৃন্দ বিতরনে উপস্থিত ছিলেন। রমজান মাস বিবেচনায় প্রতিটি ব্যাগে খাদ্য ত্রাণ হিসেবে ছিলঃ চাল ১০ কেজি, আলু ৩ কেজি, পেয়াজ ১ কেজি, লবন ১ কেজি, সয়াবিন তেল ১ লিটার, চিনি; হলুদ; মরিচ; সেমাই, সুজি ১ কেজি, প্যারাসিটামল ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইন, হাত ধােয়ার সাবান ও মাস্ক ইত্যাদি প্যাকেট ভুক্ত করা হয়েছে। ২য় বারে রোজার ঈদকে সামনে রেখে আরো বেশী পরিমানে ত্রান ২২৫ টি পরিবারের মধ্যে বিতরন করা হয় ১৮ মে ২০২০ তারিখে । এই ত্রানে ঈদে খাওয়ার জন্য সেমাই, সুজি ও চিনির ব্যাবস্থা করা হয় । এ সময়ে লালমনিরহাটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক উপস্থিত ছিলেন । ২০২০ সালে পর পর চারবার দেশের উত্তরাঞ্চল বন্যায় আক্রান্ত হয়েছিল । চরের দীর্ঘতম বন্যায় সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্থ ১০০ টি পরিবারের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ৩য় দফায় গত, ২৯ জুলাই, ২০২০ তারিখে চালের পরিমান আরো বাড়িয়ে খাদ্য সহ অন্যান্য ত্রাণ বিতরণ করা হয়। এই সময়ে আমরা বন্যা দুর্গত চরবাসীর জন্য পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সংগ্রহ করে তাদের প্রদান করি।

প্রতিটি ব্যাগে খাদ্য ত্রাণ হিসেবে ছিলঃ চাল ১২ কেজি, ডাল ১ কেজি, তেল ১/২ লিটার, লবন ১ কেজি, আলু ৩ কেজি, পেঁয়াজ ১/২ কেজি, এসএমসি স্যালাইন ১০ পিস, প্যারাসিটামল ২ পাতা, ডেটল সাবান ১ পিস, বল সাবান ৩ পিস, মাস্ক ২ পিস এবং জরুরী প্রয়ােজন মেটানাের জন্য নগদ ৩০০ টাকা। প্রতিবারের ত্রানে একটি পরিবার ১৫-২০ দিন সকলকে নিয়ে ভালোভাবে খেতে পেরেছে । ৪র্থ দফায় ২৭ নভেম্বর ২০২০ স্কাউটের চরের ২৩০ টি কর্মহীন সুবিধাবঞ্চিত পরিবারকে ২য় ও ৩য় দফায় দেয়া তালিকার অনুরুপ খাদ্য ত্রাণ প্রদান করা হয়।

করােনাকালে বন্যায় বাধ নির্মাণ: একেতো হতদরীদ্র, তার উপর করােনাকালে যখন পুরাে পৃথিবী স্থবির, থমকে গিয়েছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, এ সময়ে কাজ হারিয়ে আর্থিক ক্ষতির মধ্যে যখন একই মৌসুমে চার বার বন্যায় আক্রান্ত হয়ে ধরলার ভাঙনে ভিটে বাড়ী চলে যাচ্ছে নদী গর্ভে, তখন তারা কোন আশা খুঁজে না পেয়ে চোখে মুখে অন্ধকার দেখতে পায়। আমরা উদ্যোগ নিয়ে সোলার নির্ভর বৈদ্যুতিক ব্যাবস্থায় অনলাইনে সভা করে তাদের উদ্বুদ্ধ করি নদী ভাঙন রোধে সবাই মিলে কাজ করার জন্য। মূল খরচের ৪,০০০ বড় ফিড মিলের ব্যাগ ক্রয় করে চরবাসীকে দেই । তাঁরা অনেকে মিলে তাতে বালি মাটি ভরে ফেলতে থাকে ধরলার পাড়ে । স্থানীয় ভাবে তারা বাঁশ সংগ্রহ করে খুঁটি বানিয়ে নদীর পাড়ে পুঁতে দেয় যাতে বস্তাগুলো নদীতে ভেসে না যায় । চরবাসীর শ্রম আর আমাদের অর্থ, পরিকল্পনা ও তত্বাবধানে জেলা রোভার, জেলা স্কাউটস এর সক্রিয় অংশগ্রহন ও জেলা প্রশাসনের উৎসাহ ও তাঁদের দেয়া ৫০০ জিও ব্যাগ আমাদের ব্যাগের সাথে যুক্ত হয়ে সফল ভাবে ধরলার এক পাড়ে ভাঙন থামাতে পেরেছি । এতে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে চরের বিশাল এলাকা। আমাদের কার্যক্রম প্রকাশিত হয়েছে অনলাইন নিউজ পোর্টালে।

বাল্যবিবাহ প্রতিরােধে ও মেয়েদের উচ্চতর শিক্ষার সুযােগ করে দিতে বৃত্তি প্রদান : করােনার প্রভাবে মানুষ যখন কর্মহীন তখন লালমনিরহাট স্কাউট চরের এই হতদরিদ্র জনপদে বাল্যবিবাহের হার বেড়ে গিয়েছে। তাই গত ১১ই ফেব্রুয়ারী, ২০২১ তারিখে স্মৃতি রায় ক্রিস্টাল স্কাউট প্রাইমারি স্কুল থেকে পাশ করে এখন হাই স্কুল এবং কলেজে পড়ে এমন ২০ জন ছাত্রীকে অস্ট্রেলিয়ার একটি সংগঠনের সহায়তায় শিক্ষা খরচ দেওয়ার জন্য তাদের অভিভাকসহ স্মৃতি রায় ক্রিস্টাল স্কাউট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডেকে এনে সােলার নির্ভর স্কাইপেতে তাদের সাথে কথা বলা হয়। তাদেরকে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে জানানাে হয় এবং সকল ছাত্রীদের মাধ্যমিক পাশ না করা পর্যন্ত বিয়ে না দিয়ে পড়াশােনা চালিয়ে যাওয়ার সুফল সম্পর্কে বোঝানো হয়।